দেশের প্রকৃতচিত্র আড়াল করা যাবে না

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৯ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশে আপাতত রাজনৈতিক সংকট না থাকলেও অর্থনীতিসহ অন্যান্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক সংকটের অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম ও সরকারি বিভিন্ন সেবার দাম হু হু করে বাড়ছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা, ডলার সংকট, রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে নি¤œমুখী হওয়া, টাকার মান গত দুই বছরে ৪৩ থেকে ৫৩ শতাংশ কমে যাওয়া, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নি¤œমুখী হওয়া, ব্যাংকে সরকারের ঋণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়া থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নি¤œগামী হওয়ায় দেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব সংকটের মধ্যেই পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, এনবিআরের সদস্য মো. মতিউর রহমানের সীমাহীন দুর্নীতির খবরে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গতকালের পত্রপত্রিকায় এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের ব্যাপক দুর্নীতির খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পুলিশের বরিশাল বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও বেশুমার দুর্নীতির খবর সামনে এসেছে। আদালত এদের কারো কারো সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন। জাতীয় সংসদেও এসব দুর্নীতিবাজের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ায় পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সংবাদ প্রকাশে অধিকতর সতর্ক হওয়া নিয়ে গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে। এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে সংবাদিক, সম্পাদক ও সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনরা। তারা একে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সাবেক আইন মন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ইদানিং যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি, এগুলো একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে। তার এ বক্তব্যকে পর্যবেক্ষকরা স্ববিরোধী হিসেবে মনে করছেন। দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি কি তাহলে গোপনেই থেকে যাবে, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না, সংবাদ প্রকাশ করা হবে না? তারা কি নির্বিঘেœ দুর্নীতি করে যাবে?

পর্যবেক্ষকদের মতে, সাধারণ মানুষ যখন সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে জীবনযাপন করছে, অর্থনীতি খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন জনদৃষ্টিতে থাকা এবং যা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হবে, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রকাশ করে তাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য কিংবা এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মত্ত রাখার জন্য এ কাজ করা হয়েছে। এছাড়া এর মধ্যেই ভারতের সাথে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী কিছু চুক্তি ও সমঝোতা করে, তা যাতে আড়াল করা যায়, তারই প্রেক্ষাপট রচনা করা হয়েছে। যদিও এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। এদিকে, যাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত ও জনসম্মুখে এসেছে, তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বিদেশ চলে গেছেন, হদিস নেই। তারা এসবের তোয়াক্কা করছেন না। এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ অফিসও করছেন। দেখা যাচ্ছে, দুদক তদন্ত কাজ শুরু করলেও তাদের কারো মধ্যেই উদ্বেগ বা ভীতি কাজ করছে না। অন্যদিকে, খাল ও সড়কের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা ছাগলকা-ে আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর অবৈধ অংশ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উচ্ছেদ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠান যখন গড়ে ওঠে তখন ডিএনসিসি কোথায় ছিল? সে কি তখন ঘুমিয়ে ছিল? বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই করা হচ্ছে, জনদৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তা এবং কর্মরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত। তারা সরকারের ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে তারা নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করে এন্তার দুর্নীতি করার সুযোগ নিয়েছে। পদে থাকা অবস্থায়ই তারা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। সরকার তাদের এই বিত্তের খবর জানত না, তা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। বলতে দ্বিধা নেই, সরকার দেখেও না দেখার ভান করে তাদের বিরদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটা তাদের পুরস্কৃত করারও একটা প্রক্রিয়া। হয়ত সরকারের ঘনিষ্ঠ এমন আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা সুযোগ নিয়ে অবৈধ পন্থায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। কালক্রমে তা প্রকাশিত হলেও হতে পারে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং আলোচিত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয় কিনা।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হচ্ছে, তার পেছনে যে দেশের সার্বিক দুরবস্থাকে আড়াল করার অভিসন্ধি থাকা অমূলক নয়। সাধারণ মানুষকে এসব দুর্নীতির খবর দিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় ব্যস্ত রাখার একটি প্রক্রিয়া এবং সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা দেখানোর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জনদৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য এগুলো মোটেই কার্যকর নয়। এতে দেশের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা যাবে না। বলা বাহুল্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া একটি নিয়মিত রুটিন কাজ। হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজের খবর সামনে এনে বাহবা নেয়ার কিছু নেই। এ কাজটি যদি নিয়মিত হতো, তাহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠত না এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি প্রতিষ্ঠিত হতো। ক্যাসিনো কা-ের পর সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণা দিলেও তা কিছুদিন পর থেমে যায়। বলা বাহুল্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির মধ্যেই দুর্নীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। দুর্নীতিবাজের খবর গণমাধ্যমই প্রকাশ করেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন তা করেনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স সরকারেরই ঘোষণা। এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তিস্তা চুক্তির বিষয়ে মমতাকে ‘হ্যাঁ’ বলাতে হবে : ওবায়দুল কাদের

তিস্তা চুক্তির বিষয়ে মমতাকে ‘হ্যাঁ’ বলাতে হবে : ওবায়দুল কাদের

রাজশাহীতে বিএনপি’র সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা’র দাফন সম্পন্ন

রাজশাহীতে বিএনপি’র সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা’র দাফন সম্পন্ন

‘দুই বিষয়ে ফেল করেও কলেজে ভর্তির’ প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন

‘দুই বিষয়ে ফেল করেও কলেজে ভর্তির’ প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন

সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হামলা, ইউপি সদস্যসহ আহত ১৫

সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হামলা, ইউপি সদস্যসহ আহত ১৫

সিমেন্ট শীট ব্যবহারে প্রাণীসম্পদ খাতে বছরে  উৎপাদন বাড়বে ১২৩০০ কোটি টাকা

সিমেন্ট শীট ব্যবহারে প্রাণীসম্পদ খাতে বছরে উৎপাদন বাড়বে ১২৩০০ কোটি টাকা

পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে কখনোই শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে কখনোই শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বোয়ালমারীতে গৃহবধূকে ধর্ষণে শ্বশুরের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

বোয়ালমারীতে গৃহবধূকে ধর্ষণে শ্বশুরের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

কাওমি মাদরাসা ছাত্রদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানালেন হেফাজত নেতৃবৃন্দ

কাওমি মাদরাসা ছাত্রদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানালেন হেফাজত নেতৃবৃন্দ

ভোট জালিয়াত ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বাজেটের নৈতিক বৈধতা নেই — এবি পার্টি

ভোট জালিয়াত ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বাজেটের নৈতিক বৈধতা নেই — এবি পার্টি

সাদিক এগ্রোকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগে সাভার ডেইরী ফার্মে দুদকের অভিযান

সাদিক এগ্রোকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগে সাভার ডেইরী ফার্মে দুদকের অভিযান

যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুলিশের সক্ষমতা রয়েছে : ডিএমপি কমিশনার

যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুলিশের সক্ষমতা রয়েছে : ডিএমপি কমিশনার

স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যার দায়ে স্বামী আটক

স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যার দায়ে স্বামী আটক

জকিগঞ্জের নিখোঁজ স্কুলছাত্রী সিনহা খান মৌলভীবাজার থেকে উদ্ধার

জকিগঞ্জের নিখোঁজ স্কুলছাত্রী সিনহা খান মৌলভীবাজার থেকে উদ্ধার

গাজা থেকে ইসরাইলে ২০টি প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ

গাজা থেকে ইসরাইলে ২০টি প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ

স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে উ.কোরিয়া

স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে উ.কোরিয়া

উত্তরাঞ্চলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে

উত্তরাঞ্চলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে

খুলনায় ‘বাল্যবিবাহকে না’ বলে ৩শ’ শিক্ষার্থী’র শপথ

খুলনায় ‘বাল্যবিবাহকে না’ বলে ৩শ’ শিক্ষার্থী’র শপথ

বৈষম্যমূলক সর্বজনীন পেনশন প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি

বৈষম্যমূলক সর্বজনীন পেনশন প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি

প্রশাসন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে : মন্ত্রিপরিষদ সচিব

প্রশাসন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে : মন্ত্রিপরিষদ সচিব

পাহাড় ধসে বান্দরবানের সাথে রুমা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

পাহাড় ধসে বান্দরবানের সাথে রুমা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন